ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ

সম্প্রতি একটা লেখায় সঞ্জীব বড়ুয়ার সাক্ষাতকার পড়লাম, তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ-বিরোধী হিসাবে আমার কিছু বক্তব্য রাখলাম

উত্তর পূর্বে যদি একটা দেশ বানাতে হয় তাহলে সেটা হবে আবার আরেকটা রাষ্ট্রভিত্তিক জাতি। কারণ, ওই অঞ্চলে অসংখ্য ভাষা আর উপজাতি আছে। কুইবেক বা বাস্কের সাথে এটা তুলনীয় নয় – কারণ তাতে একটা নির্দিষ্ট অংশের জনগণ নির্দিষ্ট পরিচিতির ভিত্তিতে আলাদা হতে চান।

দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম উদাহরণ – আসাম। আসামে অহমিয়া সম্প্রদায় উলফাকে সমর্থন করেছিল, কিন্তু ২o% বাঙালী বা পশ্চিমের ১০% বড়ো উপজাতিরা সমর্থন করেনি। উলটে বড়োরা আরো একটা পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আলাদা স্বশাসিত অঞ্চল দেওয়াও হয়। যদি জাতি-রাষ্ট্র হত, তাহলে বড়োদের আলাদা দেশ দিতে হত, যেটা ওই সংক্ষিপ্ত অঞ্চলে তাদের সমস্যা ছাড়া সমাধান কিছু দিত না।

দ্বিতীয় উদাহরণ, নাগাল্যান্ড। নাগাল্যান্ডে নাগারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কম কিছু নয়। যেমন ধরা যাক কুকি দের কথা, তারা নাগাল্যান্ডের আদি বাসিন্দা। এবার যদি নাগা-পরিচালিত স্বাধীন নাগাল্যান্ড গঠিত হয় তাহলে তারা কোথায় যাবে? এখন যেমন নাগাল্যান্ডের রেডিও থেকে ২৫টি (ভেবে দেখুন) ভাষায় সম্প্রচার করা হয় (উপজাতি ১৫টির আলাদা ভাষা আর সাথে আশেপাশের রাজ্যের ভাষায় সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান), সত্যিকারের জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে হলে তাদের সবাইকে আলাদা রাষ্ট্র দিতে হবে, তাই না? এবার দেখুন নাগাল্যান্ড কতটা জায়গা নিয়ে গঠিত। সেখানে কি ৩-৪টি আলাদা রাষ্ট্রও গঠন করা সম্ভব? না কুকিরা ভুলে যেতে পারবে নাগারা কিভাবে তাদের একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে? আর একসাথে নাগা-পরিচালিত দেশে থাকতে পারবে?

উত্তর-পূর্বে যদি সব রাজ্যের মূল ট্রাইব-গুলোর সাথে কথা বলা যায় তাহলে দেখবেন তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার ভাব আছে। যদি এক লেভেল আগে গিয়ে মাইনরিটিদের সাথে কথা বলেন, তাহলে বুঝবেন তারা এই আলাদা জাতি-রাষ্ট্রকে কতটা ভয় পায়। এত সংক্ষিপ্ত অঞ্চলে যদি এত অসংখ্য ভাষাভাষি মানুষ আর এত উপজাতি থাকে তাদের এই সমস্যা স্বাভাবিক। ভারতের রাজ্যভিত্তিক শাসনব্যাবস্থার কারণে অসুবিধা কিছুটা প্রশমিত হলেও মোটের ওপর সত্যিকারের জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা উত্তর-পূর্বে সম্ভব নয়। আমরা সবাইকে দেখতে একইরকম বলে বাইরে থেকে মনে করে থাকি তারা যেন একই জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত। যে যুক্তিতে ভারতীয় মূল ভুখন্ডের বাসিন্দা হিসাবে আমি মেজরিটি আর উত্তর-পূর্ব মাইনরিটি, সেই একই যুক্তিতে উত্তর-পূর্বে প্রতিটি রাজ্যেও তো মেজরিটি আর মাইনরিটি আলাদা আছে, সেখানেও একই সমস্যা নতুন আকারে জেগে উঠবে।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হল সেনা মোতায়েন। ভারতের সব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের একটা নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স আছে। প্রথমে, বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে সরকার রাজি হয় না। তখন শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম – শুরু হয় অপহরণ, ভয় দেখানো। তখন পাঠানো হয় সেনা। বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে – যার ফলে আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী থেকে সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়। সেনা অত্যাচার শুরু করে – শুরু হয় লক-আপে মৃত্যু, গ্রাম থেকে পুরুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া। আর সেনা অত্যাচারের মাধ্যমে ব্যাপারটা পাকাপাকিভাবে সমাজে গেঁথে যায়। উদাহরণ, সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারত ও কাশ্মীর। সেনা মোতায়েন করলে তার উপজাত হিসাবে আসে অত্যাচার, আর না করলে ওই অংশের মাইনরিটি আর অন্য রাজ্য থেকে আগতদের দুর্গতি। দুটোর মধ্যে কোনটা ভালো সেটা আমি অন্তত জানি না। তবে সেনা অত্যাচার আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না, কারণ আমরা আজকে ভারতের অধিবাসী কোনো এক সময়ে এরকমই সেনা অত্যাচারের কারণেই যা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে পশ্চিম-পাকিস্তান চালিয়েছিল। আমার মতে, সেনাদের এ বিষয়ে আরো সচেতন করে তুলতে হবে। হয়ত বলা সহজ, কিন্তু সত্যিকারে কিছু নিরীহ মানুষের মাঝে বন্দুকধারীকে ছেড়ে দিলে তার মানসিকতা আর সংযমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুবই শক্ত – শত হোক, সেও মানুষ, মেশিন নয়। বাস্তবে তার কাছ থেকেও সবসময় ‘আদর্শ ব্যবহার’ পাওয়া সম্ভব নয়।

এবার আসা যাক অর্থনৈতিক সমস্যার গভীরে। ভেবে দেখুন ভারতে কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে, কিন্তু তামিলনাডু বা কেরলে নেই। এর মানে কি এই যে এই রাজ্যগুলো দিল্লী-কর্তৃক আনন্দের সাথে শাসিত হয় বা এদের কালচার দিল্লীর কালচারের সাথে খুব মেলে? তা নয়। এদের অর্থনৈতিক ব্যাপারটাকে এরা গুরুত্ব দেয় খুব বেশী। তাই এরা একসাথে দিব্যি আছে। এদের আঞ্চলিক পার্টি আছে, তারাই পর্যায়ক্রমে রাজ্য শাসন করে। দিল্লীর সাথে এদের সম্পর্ক আসে শুধু আক্ষরিক অর্থে দেশের বাইরে গেলে। লেখক বলেছেন পঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদের উদাহরণ। পঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। এই আন্দোলন এখন শেষ, কারণ অর্থনৈতিক। পাঞ্জাবীরা বুঝেছে দীর্ঘদিন লড়াই চালালে তাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। তাছাড়া, বিভিন্ন শহরে যে শিখেরা থাকে তারা ক্ষতগ্রস্ত হয়েছিল এই আন্দোলনে, যেমন কোলকাতায় শিখ-অধ্যুষিত অঞ্চলের দোকান থেকে লোকে জিনিস কিনতে যেতে ভয় পেত। আর এই আন্দোলনের কারণে আর্মিতে শিখ বা পাঞ্জাবীদের সংখ্যা কমেনি, এখনো সেনাবাহিনীর ১০% শিখ। তারা সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে ও দেশকে যথেষ্ট ভালবাসে। বাস্তবে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন মনমোহন সিং, যিনি শিখ ও পাঞ্জাবী। বাস্তবসম্মত চিন্তাই শিখ আন্দোলন শেষ হওয়ার কারণ।

অর্থনৈতিক কারণ একটা বড় কারণ। ভারত মূলত গরীব দেশ, কিন্তু গরীবদের দেশ নয়। শাসনক্ষমতা সবই প্রধানত ধনীদের কুক্ষিগত। আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে বটে, কিন্তু এখনো অনেক দিন লাগবে গরীবের শাসন কায়েম হতে। কিন্তু উত্তর-পূর্বের মানুষের অবস্থার খুব-একটা পরিবর্তন ঘটে নি এতবছরেও। তারা চোখের সামনে দেখছে পাশাপাশি রাজ্য-গুলো উন্নতি করে চলেছে, তারা পারছেনা। একটা কারণ যোগাযোগ-ব্যবস্থার অভাব (কাশ্মীরেও তাই)। অন্যটা গুরুত্বপূর্ণ – লোকসভায় জনপ্রতিনিধির সংখ্যা কম (উত্তর-পূর্বের প্রতিনিধি ২৫ জন, লোকসভার ৫৪২ জনের মধ্যে)। তাই এদের হয়ে লবি করার কেউ নেই। আমার মনে হয় এই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে অঞ্চলের সিট বাড়ানো উচিত। সেক্ষেত্রে আবার ভারতের ‘লোক-অনুপাতে সিটের’ কন্সেপ্ট ভাঙতে হয়, সেটা তখন সব রাজ্যই দাবী করে বসবে।

তৃতীয় বিশ্বে আরেকটা দেশ এরকম জাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রভিত্তিক জাতির সমস্যায় ভুগছে – সেটা আরো একটা একইরকম ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অনে জাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র – ইন্দোনেশিয়া। তাদের অনেক দ্বীপেই নিজস্ব স্বাধীনতা আন্দোলন চলে, যেমন্ সুমাত্রার উত্তরে আকে রাজ্যে, বা সুলেওয়েসিতে চলে আলাদা হবার আন্দোলন। চলত তিমুর দ্বীপে। কেন? একই কারণ – ভারতের মতই।

এবার দেখি উন্নত বিশ্বে। এক-জাতি এক-রাষ্ট্র এই কন্সেপ্ট টা পৃথিবীতে আমদানি করে ইউরোপিয়ানরা। তার আগে ‘জোর-যার-মুলুক-তার’ গোছের দেশ চলত। ইউরোপে বহুজাতিক রাষ্ট্রের ধারণা চলেনি, এই সেদিনও চেক আর শ্লোভাকেরা আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু অপরদিকে, একটা শক্তিশালী ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের ধারণাও কিন্তু ইউরোপিয়দেরই। যদিও তা এখনো সদ্যোজাত, কিন্তু তাও ইউরোপ ওই পথেই হাঁটছে – এক ইউরোপিয় পার্লামেন্ট, এক সংবিধান, এক কারেন্সী আর এক পাসপোর্ট। তার সাথে সাথে দেশে নিজস্ব ধারণাকেও সমর্থন জানানো হবে, সংস্কৃতি আলাদা বলেই যে তারা একসাথে থাকবে না, রাষ্ট্রের বেড়া রিজিড হতেই হবে সেটার তো কোনো মানে নেই। পৃথিবী এখন দেশের বেড়াজাল ভেদ করে মানুষে মানুষে সম্পর্ক গঠনে উদ্যোগ নিচ্ছে। ইন্টারনেটে বসে যে আমি এই লেখার মাধ্যমে আপনাদের মতামত জানাচ্ছি – ট্রান্সলেশন টুল দিয়ে চিনা ভাষার সাইট দেখে নিচ্ছি, সবই কিন্তু আস্তে আস্তে মানুষে মানুষে দূরত্ব কমিয়ে দেয়। আবার অপরদিকে ভেবে দেখুন, এই দূরত্ব কমাবার প্রয়াস শুরু করার জন্যও ন্যূনতম অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আর শিক্ষা লাগে, ইস্যুটা আবার ঘুরেফিরে অর্থনীতিতে আর বেসিক এডুকেশনে এসে পড়ে।

রিজিডিটির কথা এলে আমার মিজোরামের কথা মনে পড়ে। মিজোরামের মিজোদের অনেকদিনের আন্দোলন যে তাদের সাথে বর্মার মিজোদের সম্পর্ক রক্ষার জন্য সরকারি সমর্থন চাই। ইতিহাস বলে মিজোরা বর্মা ও ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। ইংরেজরা কিছুটা অংশ ভারতে আর বাকিটা বর্মাকে দিয়ে যায়। তাতে কি মানুষ কি আর থেমে থাকে? আত্মীয়-স্বজন দুটো আলাদা দেশে ভাগ হয়ে গেলে কে শান্তিতে থাকতে পারে। তার ওপর যোগ হয় বি-এস-এফের উৎপাত, ওপারে যাওয়া যাবে না। ফলশ্রুতি – আন্দোলন, প্রথমে শান্তিপূর্ণ, পরে সশস্ত্র। সমাধান কি? (আমি সমাধান শোনার পরে অবাক হয়ে গেছিলাম) খুবই সহজ। ৮০ কিমি একটা অঞ্চল দেওয়া হয়েছে যেখান দিয়ে মিজোরা দুদেশের মধ্যে যাতায়াত করতে পারবে। তাতেই মিজোরা খুশী। মূল আন্দোলন তাই আজ আর নেই, মিজোরামে এখন দিব্যি ঘুরে-বেড়িয়ে আসা যায়। মিজোরামকে এখন ভারতের ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার’ দ্বার হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। কি সহজ সমাধান – কিন্তু এর জন্য কেন সশশ্ত্র আন্দোলন করতে হল?

গত, তিন চার বছর আমি বিভিন্ন মাধ্যমে সব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি, সরকার আর সেনাবাহিনীর বক্তব্য পড়েছি। ফলাফলে, আমি আমি সমাধান খুঁজে পাইনি খুব একটা। তবে অর্থনৈতিক ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আর লেখকের সাথে ভিন্নমত। আর এও বলতে পারি, যে শিক্ষা আর অর্থনীতির সাথে এই সমস্যাও আস্তে আস্তে দূর হবে। কুইবেকে জনগণ তো ভোট দিয়ে কানাডায় অন্তর্ভুক্তির স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন, সত্যি কথা বলতে আমি রাষ্ট্র ব্যাপারটাকেই সমর্থন করতে পারি না। ধর্ম আর ভাষার মত মানুষের ওপর আবার এও এক ‘পরিচয়’ চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। মানুষই আসল, রাষ্ট্র, ধর্ম আর ভাষা সবই ভুল, আরোপিত। রাষ্ট্রনীতি গঠনের সময় সেই ব্যাপারটাতে গুরুত্ব দিলে আমার মনে হয় না সমস্যার কিছু আছে। আমি আশা করব ভবিষ্যতে ভারত-সরকার নীতি নির্ধারণের সময় ‘মেজরিটি’ আর ‘মাইনরিটি’র কথা বা ভেবে শুধু মানুষের কথা ভেবেই চিন্তা-ভাবনা চালাবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান