ঘনিষ্ঠতা ও স্বার্থপর জিন

আগের পর্ব

আরো জটিল কিছু উদাহরণের মাঝে ডুব দেওয়ার আগে চট করে একটা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলা যাক। জিন তো হল জীবের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রক – একেকটি জিন একএকভাবে জীবের প্রকৃতি ও আচরণে প্রভাব আনে। কিন্তু, এই যে লেখার শিরোনামে “স্বার্থপর জিন” বলে একটা খটমটে তত্ত্বের নাম দেখা যাচ্ছে, সেটার মানে কি? সহজ করে বললে, যে জিন জীবগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলতে সর্বদা সচেষ্ট, তাকেই বলা যায় “স্বার্থপর জিন”। রিচার্ড ডকিন্সের তত্ত্ব অনুসারে, যে জিন যত “স্বার্থপর” হবে – মানে নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধিতে যত সচেষ্ট হবে, সেই জিনই জীবজগতে বেশী করে স্থান করে নেবে। কিন্তু জিনের তো নিজস্ব কোনো সচেতনতা নেই, তাহলে সে কিভাবে স্বার্থপর হতে পারে? সমাধানটাও সহজ। যে জিনের প্রভাবে জীব নিজের জিন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে, সেই জিনই নির্বাচিত হবে – যেন, জিন চালকের আসনে বসে জীবকে নিয়ন্ত্রণ করে এমনভাবে চালাচ্ছে, যাতে সে জিনের আরো “কপি” তৈরীতে সাহায্য করে – নিজের “স্বার্থে” জীবকে চালনা করছে। “কপি” করার এক পদ্ধতি তো প্রজনন, কিন্তু আরো এক ভাবে জিনের স্বার্থপরতা প্রকাশ পায়। অন্য যে জীবের শরীরে একই জিন উপস্থিত আছে, জীবকে তার প্রতি পক্ষপাতিত্বে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু কিভাবে জানা সম্ভব কার দেহে কিসের জিন আছে? প্রকৃতিতে একটাই উপায় আছে এটা অনুমান করার – আত্মীয়তা। একদল নিকটাত্মীয়কে বাঁচানোর জন্য যদি কোনো জীব প্রাণ বিসর্জন দেয়, তাহলে তা হবে কোনো এক এরকম “স্বার্থপর জিন”-এর “প্ররোচনা” বা প্রভাবে – কারণ জীব নিজে মরে গেলেও তার জিনের “কপি” কিন্তু তার নিকটাত্মীয়দের দেহে সুরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশী। বিবর্তনের দৃষ্টিতে দেখলে, যে জিন জীবকে নিকটাত্মীয়দের সাথে ঘনিষ্ঠ করে তোলে বা তাকে নিকটাত্মীয়দের জন্য প্রাণ অবধি দিতে প্ররোচিত করে, সেই জিনের নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা বেশী – কারণ, জীবগোষ্ঠীতে এই জিনের “কপি” বেড়েই চলবে। ক্রমে, জীবের বৈশিষ্ট্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এই ঘনিষ্ঠতা – জীবজগতে এর ব্যতিক্রম মেলা দুস্কর। এই একই কারণে জীবের বাবা-মায়ের পক্ষপাতিত্ত্ব পেয়ে বড় হয়। বিজ্ঞানী ফিশার, হ্যালডেন আর সর্বোপরি হ্যামিল্টনের প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বই জনসমক্ষে এনেছেন রিচার্ড ডকিন্স তার “সেলফিশ জিন” বইতে।

হ্যামিল্টন আরো এক ধাপ এগিয়ে গাণিতিকভাবে হিসাব করার চেষ্টা করেছেন ঠিক কতটা নিকট আত্মীয় হলে তার জন্য জীব প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকে। তার বক্তব্য হল – এক জীব অপর এক জীবের সাথে যতটা জিন শেয়ার করে, ততটাই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু বাস্তবে কেউ জানে না কে কতটা জিন শেয়ার করে, তাই জীব শেয়ার করার সম্ভাবনার ওপর দিয়ে “হিসাব” করে। এই হিসাব মত, সন্তান বাবা-মায়ের ৫০% জিন শেয়ার করার সম্ভাবনা রাখে, তাই সন্তানের সাথে ঘনিষ্ঠতা ৫০% বলা যায়। একই ভাবে সন্তানদের নিজেদের মধ্যে জিন শেয়ার করার সম্ভাবনাও ৫০% – তাই তাদের মধ্যেও ঘনিষ্ঠতা সমান। কিন্তু তুতো ভাই-বোনেদের সাথে জিন শেয়ার করার সম্ভাবনা ১২.৫%, তাই এদের ঘনিষ্ঠতাও তুলনায় কম (চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই ঘনিষ্ঠতার কারণটা খুবই সহজাত। স্বার্থপর জিন জীবকে বিবর্তনে এমন পথে নিয়ে চলে যাতে তার জিন-বিস্তারে সে উদ্যোগী হয়। যার সাথে সে বেশী জিন শেয়ার করবে, তার জিন-বিস্তার একরকম তার নিজের জিন-বিস্তারের সমতুল্য – যত ঘনিষ্ঠতা বাড়বে, তত বাড়বে নিজের জিন বিস্তারের সম্ভাবনা। এখন এ থেকে সহজেই অনুমেয় কিভাবে জীব তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয় – নিজে মরে গেলেও তার জিন-বিস্তারের সম্ভাবনা মরে না। তাই এই পরোপকারী জিন বিস্তৃত হয় – জীবসমাজে স্থান করে নেয়।

এবার অনেকেই প্রশ্ন করবেন কেন অপত্যের তুলনায় বাবা-মায়ের আত্মবিসর্জন দেবার প্রবণতা বেশী দেখা যায় জীবজগতে? কারণ ব্যাখ্যা করা যায় অন্য দৃষ্ঠিভঙ্গী থেকে। অপত্য জীবের বয়স কম বলে তার জিন সঞ্চারের সম্ভাবনাও বেশী বাবা-মায়ের তুলনায়। তাই অপত্যস্নেহের জিন ভারসাম্য রেখে জীবসমাজে স্থান পেয়ে গেছে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় যে মনে করা যাক এক বাবার মধ্যে এই অপত্য-স্নেহের জিন আছে। তার চার বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে সে মারা গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই অপত্য-স্নেহের জিন তাদের বংশবিস্তারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে, আর বাড়িয়ে তোলে জিনপুলে নিজের অস্ত্বিত্ত্ব। তাই এই অপত্য-স্নেহের জিন আসলে একটি স্বার্থপর জিন – জিনপুলে নিজের সংখ্যা বাড়াতে সদা-“সচেতন”। অন্যদিকে, স্বার্থপর জিন মোটেও জীবকে স্বার্থপর করে তোলে না, বরং ঘনিষ্ঠদের ক্ষেত্রে পরোপকারী করে তোলে।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান