বিজয় দিবস নিয়ে সবাই লিখছে বলে ভারতীয় হিসাবে আমারো কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে, কিছু ভারতীয়র অবদান বাংলাদেশের আপামর জনগণের জানা উচিত বলেই আমি মনে করি। বিজয় দিবসে বাংলাদেশের মত ভারতেও বেশ কিছু শহিদের কথা স্মরণ করা হয় – বিশেষত যারা ১৯৭১এর যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ প্রান্তরেই হয়নি, হয়েছিল কাশ্মীর আর পাঞ্জাব সীমান্তেও। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পাশাপাশি কাশ্মীরেও অনেক অংশ হস্তান্তরিত হয়ে ভারতের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তারই মধ্যে একটি শহর হল কারগিল – যা নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ১৯৯৯ সালে আবার একটি যুদ্ধ হয়।
যাহোক, আসা যাক প্রথম শহিদ এলবার্ট এক্কার কথায়। এক্কা রাঁচির আদিবাসী খ্রীষ্টান পরিবারের সন্তান। ২০ বছর বয়সে উনি যোগদান করেন ভারতীয় সেনার বিহার রেজিমেন্টে ১৪ গার্ডস সেকশনে। ১৯৭১ এর যুদ্ধের সময়ে উনি গঙ্গাসাগর (আগরতলা থেকে সাড়ে ৬ কিমি দূরে) সীমান্তে প্রহরারত ছিলেন। চৌথা ডিসেম্বর অর্ডার আসে শত্রুবাহিনীর বাংকার দখল করতে হবে। ভোর চারটের সময় শুরু হয় যুদ্ধ। উলটো দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলিগোলা চালাতে শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুসারে, সাথে বন্দুক থাকলেও বন্দুকের ব্যবহার ছিল সীমিত, কারণ বন্দুক চালালে সব বাংকারের লোক একসাথে জেনে যাবে কোথা থাকে শত্রু আক্রমণ করছে। বুকে ভর দিয়ে মাটিতে ঘষটে ঘষটে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে একের পর এক বাংকারে শত্রুকে উনি বেয়নেটবিদ্ধ করেন। শেষে, যখন অধিকাংশ বাংকার করায়ত্ত, তখন পাশের একটি বড় বিল্ডিং থেকে শুরু হয় লাইট মেশিন-গানের বোমাবর্ষণ। গুরুতর রক্ম আহত হন এক্কা। উনি বাধ্য হয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে শত্রুকে ঘায়েল করেন এবং অসীম সাহসের সাথে দেওয়াল ডিঙিয়ে বিল্ডিং-এ ঢুকে তার মেশিন-গান চুপ করিয়ে দেন। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণ হারা এক্কা।
গঙ্গাসাগরের পতনের ফলে ভারতীয় সেনারা ওই পথে দ্রুত ঢুকে পড়ে যা বিজয় ত্বরাণ্বিত করেছে। পরে, মরণোত্তর পরম বীর চক্র দিয়ে এক্কাকে সম্মান দেওয়া হয়। রাঁচী শহরের কেন্দ্রস্থলের নাম রাখা হয় এক্কা চৌক।
পরম বীর চক্র ভারতের সৈনিকদের সর্বোচ্চ সম্মান। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে চারজন এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এক্কা একজন। বাকি দুজন পাঞ্জাবে (অরুণ ক্ষেত্রপাল আর হুঁশিয়ার সিং) আর একজন (নির্মলজিত সিং শেখোঁ) কাশ্মীরে যুদ্ধের সময় বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন।
এতো গেল সাহসিকতার কথা, এরপরে আসা যাক যুদ্ধের পরিকল্পনা ও কৌশলের কথায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গরিলা কায়দায় যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেবার কৌশল যার – তিনি হলেন জেনারেল জ্যাকব। কোলকাতার ইহুদী পরিবারে জন্ম এই সেনানায়কের। ভারতীয়রা তখন গেরিলা কায়দায় যুদ্ধের কৌশলের সাথে পরিচিত ছিল না। ইনিই ভারত সরকার আর সেনাপ্রধানকে বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন ট্রেনিং ক্যাম্প বানাতে। যুদ্ধোত্তর ভারতে ১৯৭১ এর বিজয়ের জন্য একেই সবথেকে বেশী কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ইনি পরবর্তীকালে বিজেপি তে যোগদান করেন ও ইজরায়েল-ভারত সম্পর্ক স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
আর ছিলেন ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ। পাঞ্জাবী পার্সী পরিবারে জন্ম নেওয়া এই সেনানায়কও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্তন সেনানী। যুদ্ধের সঠিক দিনক্ষণ নির্ধারণে মানেকশর জুড়ি মেলা ভার ছিল। যুদ্ধের স্থায়ীত্ব কমিয়ে আনার জন্য এবং পাকিস্তানী বাহিনীর দ্রুত আত্মসমর্পণের কৃতিত্ব অনেকটাই এর প্রাপ্য।
আর যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন জেনারেল অরোরা, সেনাপ্রধান। এর ছবি দেখে অনেকেই অভ্যস্ত, আত্মসমর্পণরত নিয়াজীর সাথে। মজার কথা হল, এই জগজিত সিং অরোরার জন্ম হল অধুনা পাকিস্তানের ঝীলমে – এক ধার্মিক শিখ পরিবারে। ১৯৭১ এর যুদ্ধশেষে এঁকেও বাংলাদেশ সরকার বীরপ্রতিক উপাধীতে ভূষিত করেন। অরোরা ছিলেন কম কথার কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধির ধর্মভীরু মানুষ। পরবর্তীকালে অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে সেনা হামলার পরে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হননি। অরোরা অকালি দলের হয়ে ভারতে রাজ্যসভায় প্রতিনিধিও ছিলেন। গত ২০০৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ ও ভারত – উভয়েই তার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩৫ বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু আমার মনে হয় এখনও ভারতে এই যুদ্ধ ভারত-পাক যুদ্ধ বলেই বেশী খ্যাত আর যুদ্ধে স্মরণীয় হয় সৈন্যরাই। মনে রাখা হয়না বীর বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের বা গণহত্যার শিকার ৩০ লক্ষ বাঙালীকে। আর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ হলেও মৃত ভারতীয়দের জন্য কোনো অনুষ্ঠান হয় না। অথচ উভয় দেশের জন্যই স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল, যা হয়ত একে অপরের সাহায্য ছাড়া অর্জন করা অনেক কঠিন হত।
মন্তব্য করুন